শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ০২:৫৯ অপরাহ্ন

করোনাকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে

করোনাকালে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রাণঘাতি কোভিড-১৯ কেবল মানুষের দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, একইসঙ্গে মানুষের মানবিক, আত্মিক, সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করেছে। করোনাকালে মানুষের গৃহবন্দী এবং কর্মহীন সময়ে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন বেড়েছে। সারা বিশ্বে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত না হওয়ায় অদূর ভবিষ্যতে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। করোনাকালে অধিকাংশ সময় ঘরে থাকায় মানুষের স্বাভাব, আচার আচরণ এবং দৈনন্দিন কর্মসূচিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ঘরে বসে কর্মহীন থাকার ফলে পুরুষরা হয়ে উঠেছে অনেকটা খিটখিটে, অসহিঞ্চু, অধৈর্য। ফলে তাদের ক্ষোভ, অসন্তোষ, অসহিঞ্চুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে ঘরের নারী ও শিশুর ওপর।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক জরিপে জানা গেছে, নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে বাল্যবিবাহও। গত নয় মাসে ৯৭৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে ৪৩ জনকে।

এছাড়াও, এই সময়ে যৌতুক নিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৬৮ জন এবং এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ২১ জন নারী। এদিকে, করোনাকালীন সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ করতে না পারায় সংহিসতা আরো বাড়ছে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

সম্প্রতি বিশ্বের ৮০টি দেশে জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশ দেশেই টিকাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হয়েছে। ফলে প্রায় তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস ও হুপিং কাশি প্রতিরোধী টিকাদানের হার কম দেখা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস অধানম গ্যাব্রিয়েসুস বলেছেন, টিকা না পাওয়ায় শিশুদের মধ্যে রোগ সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।

ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) না থাকা, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, স্বাস্থ্যকর্মী সংকটের কারণে চলতি বছর শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০টি হাম প্রতিরোধী টিকাদান অভিযান বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের তথ্যমতে, করোনা মহামারির আগে থেকেই হামের ভয়াবহ সংক্রমণের মুখে ছিল বিশ্ব। ২০১৮ সালে এতে আক্রান্ত হয়েছিলেন অন্তত ১ কোটি মানুষ, এর মধ্যে মারা গেছেন কমপক্ষে ১ লাখ ৪০ হাজার। মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু। ইউনিসেফের হিসাবে, প্রতিবছর সময়মতো টিকাদানের কারণে জীবন বেঁচে যায় অন্তত ৩০ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের। তারপরও বহু জায়গা এ কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে, প্রতিবছর এমন ১৫ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন, যাদের টিকা দিতে পারলে হয়তো জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো।

সম্প্রতি মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘কোভিড-১৯ ক্রান্তিকালে নারী ও কন্যাশিশু প্রতি সহিংস পরিস্থিতি এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা সংকটকালীন নারীর প্রতি সব ধরণের সহিংসতা, বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধির সাথে সাথে নির্যাতনের এক ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। গণধর্ষণ, শিশু ও নারী এমনকি প্রতিবন্ধী ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, বৈবাহিক ধর্ষণ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সাইবার ক্রাইম ও পাচারসহ শিশু ও প্রতিবন্ধী নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সৃষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে দূর করতে হলে আলাদা ভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। একই সাথে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য চলমান কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরসনে প্রশাসনের ভূমিকা আরো কার্যকর ও জোরদার করতে হবে। নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিদ্যমান হটলাইনগুলোর কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে নারী শিক্ষার হার বাড়াতে বিদ্যমান উপবৃত্তির আওতা বৃদ্ধিসহ অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম মেয়েদের নাগালে নিতে হবে, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ভার্চুয়াল কোর্টের এখতিয়ার বৃদ্ধি করতে হবে। সীমিত পরিসরে হলেও গুরুত্বপূর্ণ পুরানো মামলার শুনানি ভার্চুয়াল কোর্টে হতে হবে। মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে ১৫ দফা সুপারিশ করা হয়।

নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতনের প্রভাব অত্যন্ত সুদুরপ্রসারী, যা একটি দেশের উন্নয়নে পথে অন্তরায়। এ মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায় এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি, দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কাঠোর শাস্তি দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নারীর আইনগত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে একটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল রয়েছে। নির্যাতিত নারীরা এ সেলের মাধ্যমে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা পেয়ে থাকেন। এছাড়া, দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, দক্ষ বিচারক দ্বারা ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নির্যাতিত নারীরা নিজ জেলা থেকে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা পেতে পারেন। জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়া যায়।

নির্যাতিত নারীদের আইনি সুরক্ষা দিতে ২০০০ সালে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করে। সে আইনকে ২০১৩ সালে সংশোধন করে অধিকতর কঠোর করা হয়। আইনি প্রতিকার চাইলে বিচার প্রার্থীরা কোথায় সুবিচার পেতে পারেন, কিভাবে আইনি সুবিধা পাবেন তাও সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইনে নারী নির্যাতনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে সরকার তৎপর রয়েছে। নারী নির্যাতনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং সাজা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

আমাদের প্রত্যাশা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নারী এবং শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আরো মনোযোগী এবং শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবে। একইসঙ্গে শিশু ও নারীর জন্য পরিবার, সমাজ হবে শান্তি, সুরক্ষার বিশ^স্থ ঠিকানা। কারণ, নারী ও শিশুর জীবন বিপন্ন করে, তাদের জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রেখে একটি সুন্দর পরিবার, সমাজ গঠন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ, অগ্রগতি, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, তাদের সুরক্ষা দেয়া সবার নৈতিক দায়িত্ব।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877